প্রকাশিত: Mon, Feb 13, 2023 4:25 PM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 7:44 AM

রাষ্ট্রপতিকে দেখতে দলীয় দৃষ্টিকোণ নয়

কবির য়াহমদ : রাষ্ট্রের শীর্ষ পদ রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি, তবে এই পদের প্রতি আগ্রহী মানুষের সংখ্যা সীমিত। এমনকি সাধারণের মাঝেও এ আলোচনা সামান্য। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার সুবাদে রাজনৈতিক সকল আলোচনা প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ কারণে শোক প্রকাশ করা, বিভিন্ন দিবসে বাণী দেওয়া আর কবর জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর কাজ নেই বলে অনেকে বলে থাকেন। যদিও দাপ্তরিক ক্ষমতা না থাকলেও আইনসহ অনেক কিছুই রাষ্ট্রপতির নামে হয়ে থাকে। 

সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হয়। দ্বাদশ সংশোধনী রাষ্ট্রপতিকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কী পরামর্শ দিচ্ছেনÑ এটাও আলোচনা করা যাবে না। এই সংশোধনী পাস করেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সকল দলগুলো, এরশাদ পতনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রে দেশের উত্তরণের পথ পরিক্রমায়। 

দ্বাদশ সংশোধনী প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাবান করেছে, কমিয়েছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা। এর সুফল ভোগ করেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ’দলই। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, শেখ হাসিনাও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, আছেন। বিএনপির আমলে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন আবদুর রহমান বিশ্বাস, ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী, জমির উদ্দিন সরকার, ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ; আওয়ামী লীগের আমলে হয়েছেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ, জিল্লুর রহমান, মো. আবদুল হামিদ। আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষের পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। 

লক্ষণীয় বিষয় হলো আলঙ্কারিক পদে পরিণত রাষ্ট্রপতির থেকেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুইবার হতাশ হয়েছে। জননিরাপত্তা আইনে সাক্ষর না করে ফেরত পাঠানো নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছিল রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের। আর জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারতে না গিয়ে বিএনপির রোষানলে পড়েন বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী। এছাড়া আছে পিএসসির চেয়ারম্যান নিয়োগের ফাইলে সাক্ষর না ফেরত পাঠানো এবং রাষ্ট্রপতির বাণীতে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক না বলা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব বাড়লেও মেয়াদ শেষ করতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন, কিন্তু ডা. বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরীকে মেয়াদ পূরণের সুযোগ দেয়নি বিএনপি; অপমান করে বিদায় করেছিল। সেটা লজ্জার এক ইতিহাস হয়ে আছে।

দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। এই পদে আর কোনো প্রার্থী না থাকায় সংসদে ভোটাভুটির দরকার পড়ছে না। তিনিই নির্বাচিত নতুন রাষ্ট্রপতি। একমাত্র প্রার্থী হিসেবে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেয়াদ থাকায় ২৪ এপ্রিল থেকে তিনি দায়িত্ব নেবেন। 

নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে কী প্রত্যাশাÑ এমন প্রশ্নে অনেকে রাষ্ট্রপতির সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন। স্বাভাবিক। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নির্বাচনকালীন তাঁর কিছু ভূমিকা যে আছে সেটা বলাই বাহুল্য। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে পদবির যে ওজন সেটা দিয়েও রাজনৈতিক অচলাবস্থাসহ বিবিধ সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করা যায়। ইতিবাচকভাবে জিল্লুর রহমান চেষ্টা করেছিলেন, আবদুল হামিদ চেষ্টা করেছিলেন; যদিও সাফল্য মেলেনি। আর বিপরীতে আরেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন যেটা করেছিলেন সেটা ন্যক্কারজনক; দেশের ঘাড়ে চেপেছিল ওয়ান-ইলেভেনের ভূত! 

আলঙ্কারিক পদ হয়ে পড়া রাষ্ট্রপতি নিয়ে মানুষের খুব বেশি আগ্রহ যে আছে সেটা বলা যাবে না। এই পদে আসীন হতে ইচ্ছুক রাজনীতিবিদও খুব বেশি দেখা যায় না। যদিও এটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ, তবু রাজনীতিবিদদের মধ্যে এনিয়ে মাতামাতি নেই, রাজনৈতিক-সামাজিকসহ বিবিধ আলোচনা নেই।

নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে নিয়ে কোনো আগ্রহ ও মন্তব্য নেই, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন। আগ্রহ থাকবে না কেন? এটা কি একটা সাংবিধানিক পদকে অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা নয়? ক্ষমতায় যারা থাকে তাদের মনোনয়নেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে আসছেন। বিএনপিও তাদের সময়ে দলীয় কিংবা নিজেদের লোককে মনোনয়ন দিয়েছে, আওয়ামী লীগও দিয়েছে, দিচ্ছে; যদিও আওয়ামী লীগের আমলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন না আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়েরই সাবেক কিংবা তৎকালের নেতা।

সাত সংসদ সদস্যের পদত্যাগের পর সংসদে বর্তমানে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি নেই। বিএনপির সাতজনের এই পদত্যাগ আন্দোলনের কৌশলের অংশ হিসেবে। এই আন্দোলন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যেই। ক্ষমতায় যেতে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের শীর্ষ সাংবিধানিক পদের প্রতি আগ্রহ না থাকার প্রকাশ্য মন্তব্য অপ্রত্যাশিত! 

সময়ই বলবে আগামীতে কারা সরকার গঠন করবে, কিন্তু ক্ষমতায় যারাই থাকুক সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫ বছর। রাষ্ট্রপতিকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি হিসেবে দেখা তাই সমীচীন নয়, রাষ্ট্রপতি পদে ব্যক্তি দায়িত্ব নিলেও এটা প্রতিষ্ঠান। 

লেখক: সাংবাদিক